মানুষের (চরিত্র ও কর্মের) উৎকৃষ্ট অংশ গ্রহণ করুন, সৎকাজের নির্দেশ দিন এবং অজ্ঞদেরকে এড়িয়ে চলুন [১]।
[১] আলোচ্য আয়াতগুলোতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বোত্তম চরিত্রের হেদায়াত দেয়া হয়েছে। [সা’দী] তাতে তিনটি বাক্য রয়েছে। প্রথম নির্দেশ হচ্ছে, আপনি (عفو) গ্রহণ করুন। এখানে উল্লেখিত (العفو) শব্দটির আরবী অভিধান মোতাবেক একাধিক অর্থ হতে পারে এবং একত্রে সব ক'টি অর্থই প্রযোজ্য হতে পারে। সে কারণেই তাফসীরবিদ আলেমগণের বিভিন্ন দল বিভিন্ন অর্থগ্রহণ করেছেন। (এক) অধিকাংশ তাফসীরকার যে অর্থ নিয়েছেন তা হল এই যে, (عفو) বলা হয় এমন প্রত্যেকটি কাজকে, যা সহজে কোন রকম আয়াস ব্যতিরেকে সম্পন্ন হতে পারে। [ইবন কাসীর] তাহলে বাক্যটির অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আপনি এমন বিষয় গ্রহণ করে নিন, যা মানুষ অনায়াসে করতে পারে। অর্থাৎ শরীআত নির্ধারিত কর্তব্য সম্পাদনে আপনি সাধারণ মানুষের কাছে সুউচ্চমান দাবী করবেন না; বরং তারা সহজে যে পরিমাণ আমল করতে পারে আপনি তাই গ্রহণ করে নিন। মুফাসসিরগণের মতে, এ আয়াতটিতে আল্লাহ্ তা'আলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মানুষের আমল-আখলাকের ব্যাপারে সাধারণ আনুগত্য কবূল করে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে্যা [আত-তাফসীরুস সহীহ] অর্থাৎ মানুষ যা করতে পারে তার প্রকাশ্য রূপ দেখেই আমি সন্তুষ্ট থাকব। তাদের প্রকৃতি যেটা করতে সমর্থ নয় সেটা তাদের উপর চাপিয়ে দেব না। তাদের ভুল-ত্রুটি হলে সেটা উপেক্ষা করে যাব। তাদের উপর কঠোরত আরোপ করব না [ইবন কাসীর; সাদী; ফাতহুল কাদীর]
(দুই) (عفو) এর অপর অর্থ ক্ষমা করা এবং অব্যাহতি দেয়াও হয়ে থাকে। তাফসীরকার আলেমগণের এক দল এক্ষেত্রে এ অর্থেই বাক্যটির মর্ম সাব্যস্ত করেছেন এই যে, আপনি পাপী-অপরাধীদের ক্ষমা করে দিন। [ইবন কাসীর, যায়দ ইবন আসলাম হতে]
আয়াতের দ্বিতীয় নির্দেশ হচ্ছে, আপনি – (عرف) এর নির্দেশ দিন। এখানে (العرف) শব্দটির অর্থ, সৎকাজ বা পরিচিত কাজ। যে কোন ভাল ও প্রশংসনীয় কাজই এর অন্তর্ভুক্ত। ইবন কাসীর অর্থাৎ যেসব লোক আপনার সাথে মন্দ ও উৎপীড়নমূলক আচরণ করে, আপনি তাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন না; বরং তাদেরকে ক্ষমা করে দিন। কিন্তু সেই সাথে তাদেরকে সৎকাজেরও উপদেশ দিতে থাকুন। অর্থাৎ অসদাচরণের বিনিময় সদাচরণ এবং অত্যাচারের বিনিময় শুধুমাত্র ন্যায়নীতির মাধ্যমেই নয়; বরং অনুগ্রহের মাধ্যমে দান করুন।
আয়াতের তৃতীয় নির্দেশ হচ্ছে, আপনি জাহেল বা মূখদেরকে উপেক্ষা করুন। যারা জাহেল তাদের কাছ থেকে আপনি দূরে সরে থাকুন। মর্মার্থ এই যে, আপনি অত্যাচারের প্রতিশোধ না নিয়ে তাদের সাথে কল্যাণকর ও সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার করুন এবং একান্ত কোমলতার সাথে তাদেরকে সত্য ও ন্যায়ের বিষয় বাতলে দিন। কিন্তু বহু মূর্খ এমনও থাকে যারা এহেন ভদ্রোচিত আচরণে প্রভাবিত হয় না; বরং এমতাবস্থায়ও তারা মূর্খজনোচিত রূঢ় ব্যবহারে প্রবৃত্ত হয়। এমন ধরনের লোকদের সাথে আপনার আচরণ হবে এই যে, তাদের হৃদয়বিদারক মূর্খ-জনোচিত কথা-বার্তায় দুঃখিত হয়ে তাদেরই মত ব্যবহার আপনিও করবেন না; বরং তাদের থেকে দূরে সরে থাকবেন। তাফসীরশাস্ত্রের ইমাম ইবনে-কাসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ দূরে সরে থাকার অর্থও মন্দের প্রত্যুত্তরে মন্দ ব্যবহার না করা। এর অর্থ এই নয় যে, তাদের হেদায়াত করাও বর্জন করতে হবে। কারণ, এটা রিসালাত ও নবুওয়তের দায়িত্ব এবং মর্যাদার যোগ্য নয়। এক্ষেত্রে আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত একটি ঘটনা রয়েছে যে, উমার ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফত আমলে উয়াইনাহ ইবনে হিসন একবার মদীনায় আসে এবং স্বীয় ভ্রাতুস্পপুত্র হুর ইবন কায়সের মেহমান হয়। হুর ইবনে কায়স ছিলেন সে সমস্ত বিজ্ঞ আলেমদের একজন যারা ফারূকে আযম রাদিয়াল্লাহু আনহুর পরামর্শ সভায় অংশগ্রহণ করতেন। উয়াইনাহ স্বীয় ভ্রাতুস্পপুত্র হুরকে বললঃ তুমি তো আমীরুল মু'মীনের একজন অতি ঘনিষ্ঠ লোক; আমার জন্য তার সাথে সাক্ষাতের একটা সময় নিয়ে এসো। হুর ইবনে কায়স রাদিয়াল্লাহু আনহু উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট নিবেদন করলেন যে, আমার চাচা উয়াইনাহ আপনার সাথে সাক্ষাত করতে চান। তখন তিনি অনুমতি দিয়ে দিলেন। কিন্তু উয়াইনাহ উমার ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুর দরবারে উপস্থিত হয়েই একান্ত অমার্জিত ও ভ্রান্ত কথাবার্তা বলতে লাগল যেঃ “আপনি আমাদেরকে না দেন আমাদের ন্যায্য অধিকার, না করেন আমাদের সাথে ন্যায় ও ইনসাফের আচরণ। উমার ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু তার এসব কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে হুর ইবন কায়স নিবেদন করলেনঃ হে আমীরুল মুমিনীন, আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেছেন, “আপনি ক্ষমা করুন, সৎকাজের নির্দেশ দিন এবং অজ্ঞদেরকে এড়িয়ে চলুন" আর এ লোকটিও জাহেলদের একজন'। এই আয়াতটি শোনার সাথে সাথে উমার ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুর সমস্ত রাগ শেষ হয়ে গেল এবং তাকে কোন কিছুই বললেন না। উমার ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহুর ব্যাপারে প্রসিদ্ধ ছিল যে, আল্লাহর কিতাবে বর্ণিত হুকুমের সামনে তিনি ছিলেন উৎসর্গিত প্ৰাণ। [বুখারীঃ ৪৬৪২]