আর সত্য ও ন্যায়ের দিক দিয়ে আপনার রব-এর বাণী পরিপূর্ণ [১] তাঁর বাক্যসমূহের পরিবর্তনকারী কেউ নেই [২]। আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ [৩]।
[১] এ আয়াতে কুরআনুল কারমের আরো দুটি বৈশিষ্ট্যমূলক অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। এগুলোও কুরআনুল কারীম যে আল্লাহর কালাম, এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। বলা হয়েছে, আপনার রব-এর কালাম সত্যতা, ইনসাফ ও সমতার দিক দিয়ে সম্পূর্ণ। তার কালামের কোন পরিবর্তনকারী নেই। এখানে (وَتَمَّتْ) শব্দে পরিপূর্ণ হওয়া বর্ণিত হয়েছে এবং (كَلِمَتُ رَبِّكَ) বলে কুরআনকে বুঝানো হয়েছে। [তাবারী] কুরআনের গোটা বিষয়বস্তু দু'প্রকার- (এক) যাতে বিশ্ব ইতিহাসের শিক্ষণীয় ঘটনাবলী, অবস্থা, সৎকাজের জন্য পুরস্কারের ওয়াদা এবং অসৎ কাজের জন্য শাস্তির ভীতি-প্রদর্শন বর্ণিত হয়েছে এবং (দুই) যাতে মানব জাতির কল্যাণ ও সাফল্যের বিধান বর্ণিত হয়েছে। কুরআনুল কারীমের এ দু'প্রকার সাফল্য সম্পর্কে (صِدْقًا وَّعَدْلًا) দুই অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। (صدق) এর সম্পর্ক প্রথম প্রকারের সাথে; অর্থাৎ কুরআনে যেসব ঘটনা, অবস্থা, ওয়াদা ও ভীতি বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো সবই সত্য ও নির্ভুল। এগুলোতে কোনরূপ ভ্রান্তির সম্ভাবনা নেই। (عدل) এর সম্পর্ক দ্বিতীয় প্রকার অর্থাৎ বিধানের সাথে। উদ্দেশ্য এই যে, আল্লাহ তা'আলার সব বিধান (عدل) তথা ন্যায়বিচার ভিত্তিক। [ইবন কাসীর] অতএব, আয়াতের উদ্দেশ্য এই যে, আল্লাহর বিধান সুবিচার ও সমতার উপর ভিত্তিশীল। এতে কারো প্রতি অবিচার নেই এবং এমন কোন কঠোরতাও নেই যা মানুষ সহ্য করতে পারে না। অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছেঃ
(لَا يُكَلِّفُ اللّٰهُ نَفْسًا اِلَّا وُسْعَهَا)
অর্থাৎ “আল্লাহ ক্ষমতা ও সামর্থ্যের বাইরে কারো প্রতি কোন বাধ্যবাধকতা আরোপ করেননি"। [সূরা আল-বাকারাহঃ ২৮৬]
কুরআনুল কারীমের এ অবস্থাটি অর্থাৎ কুরআনে বর্ণিত অতীত ও ভবিষ্যতের ঘটনাবলী, পুরস্কারের ওয়াদা ও শাস্তির ভীতি-প্রদর্শন সবই সত্য; এসব ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। কুরআন বর্ণিত যাবতীয় বিধান সমগ্র বিশ্ব ও কেয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী বংশধরদের জন্য সুবিচার ও সমতাভিত্তিক, এগুলোতে কারো প্রতি কোনরূপ অবিচার নেই এবং সমতা ও মধ্যবর্তিতার চুল পরিমাণও লঙ্ঘন নেই। কুরআনের এ বৈশিষ্ট্য আরো প্রকৃষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, কুরআন আল্লাহর কালাম।
[২] কুরআনের আরো একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, (لَامُبَدِّلَ لِكَلِمٰتِهٖ) অর্থাৎ আল্লাহর কালামের কোন পরিবর্তনকারী নেই।’ তিনি যেটা যে সময়ে হবে বলেছেন সেটা সে সময়ে অবশ্যই অনুষ্ঠিত হবে। সেটাকে রদ বা পরিবর্তন করার কোন ক্ষমতা কারো নেই। [তাবারী] ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এর অর্থ বলেন, আল্লাহর ফয়সালাকে কেউ রদ করতে পারবে না। তাঁর বিধানকে পরিবর্তন করার অধিকার কারও নেই। অনুরূপভাবে তাঁর ওয়াদার বিপরীতও হবার নয়। [বাগভী] পরিবর্তনের এক প্রকার হচ্ছে যে, এতে কোন ভুল প্রমাণিত করার কারণে পরিবর্তন করা। পূর্ব আয়াতে আল্লাহর কালামকে পূর্ণ বলার কারণে কারো মনে আসতে পারে যে, কোন কিছু পূর্ণ হওয়ার পর তাতে কি আবার অপূর্ণাঙ্গতা আসবে? এ রকম প্রশ্নের উত্তর এখানে দেয়া হয়েছে। আর পরিবর্তনের দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে জবরদস্তিমূলকভাবে পরিবর্তন করা। যেমন এর পূর্বে তাওরাত ও ইঞ্জীলকে পরিবর্তন করা হয়েছে। আল্লাহর কালাম এ সকল প্রকার পরিবর্তনেরই উর্ধ্বে। আল্লাহ তা'আলা স্বয়ং ওয়াদা করেছেনঃ
(اِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَاِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوْنَ)
অর্থাৎ “আমরাই এ কুরআন নাযিল করেছি এবং আমরাই এর সংরক্ষক"। [সূরা আল-হিজর;৯] এমতাবস্থায় কার সাধ্য আছে যে, এ রক্ষাবূহ্য ভেদ করে এতে পরিবর্তন করে? [রুহুল মা'আনী] কুরআনের উপর দিয়ে চৌদ্দশত বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। প্রতি শতাব্দি ও প্রতি যুগে এর শক্রদের সংখ্যাও এর অনুসারীদের তুলনায় বেশী ছিল; কিন্তু এর একটি যের-যবর পরিবর্তন করার সাধ্যও কারো হয়নি। অবশ্য একটি তৃতীয় প্রকার পরিবর্তন সম্ভবপর ছিল। তা এই যে, স্বয়ং আল্লাহ্ তা'আলা কুরআনকে রহিত করে পরিবর্তন করতে পারতেন। কিন্তু এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, কুরআনের পরে আর কোন নবী ও কিতাব আসবে না। এমনকি ঈসা আলাইহিস সালাম যখন আবার আসবেন তিনি এ কুরআন অনুসারেই জীবন অতিবাহিত করবেন। রুহুল মা'আনী] এ আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ রাসূল এবং কুরআন সর্বশেষ কিতাব। একে রহিতকরণের আর কোন সম্ভাবনা নেই। কুরআনের অন্যান্য আয়াতে এ বিষয়বস্তুটি আরো সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।
[৩] আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে (وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ) অর্থাৎ তারা যেসব কথাবার্তা বলছে, আল্লাহ সব শোনেন এবং সবার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত অবস্থা জানেন। তিনি প্রত্যেকের কার্যের প্রতিফল দেবেন। [তাবারী; আল- মানার; আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]