আর স্মরণ করুন, যখন মূসা তার সঙ্গী যুবককে [১] বলেছিলেন, দু’সাগরের মিলনস্থল না পৌছে আমি থামব না অথবা আমি যুগ যুগ ধরে চলতে থাকব [২]।
নবম রুকু’
[১] এ ঘটনায় মূসা' নামে প্রসিদ্ধ নবী মূসা ইবনে ইমরান 'আলাইহিস সালাম-কে বোঝানো হয়েছে। فتى এর শাব্দিক অর্থ যুবক। শব্দটিকে কোন বিশেষ ব্যক্তির সাথে সম্বন্ধ করা হলে অর্থ হয় খাদেম। [ফাতহুল কাদীর] বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে যে, এই খাদেম ছিল ইউশা’ ইবনে নূন। [ইবন কাসীর]
مَجْمَعَ الْبَحْرِيْنِ -এর শাব্দিক অর্থ দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থল। বলাবাহুল্য, এ ধরনের স্থান দুনিয়াতে অসংখ্য আছে। এখানে কোন জায়গা বোঝানো হয়েছে, কুরআন ও হাদীসে তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। তাই ইঙ্গিত ও লক্ষণাদী দৃষ্টে তাফসীরবিদদের উক্তি বিভিন্নরূপ। [ফাতহুল কাদীর]
[২] হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ “একদিন মূসা 'আলাইহিস সালাম বনী-ইসরাঈলের এক সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করলঃ সব মানুষের মধ্যে অধিক জ্ঞানী কে? মূসা “আলাইহিস সালাম-এর জানামতে তার চাইতে অধিক জ্ঞানী আর কেউ ছিল না। তাই বললেনঃ আমিই সবার চাইতে অধিক জ্ঞানী। আল্লাহ তা'আলা তাঁর নৈকট্যশীল বান্দাদেরকে বিশেষভাবে গড়ে তোলেন। তাই এ জবাব তিনি পছন্দ করলেন না। এখানে বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়াই ছিল আদব। অর্থাৎ একথা বলে দেয়া উচিত ছিল যে, আল্লাহ তা'আলাই ভাল জানেন, কে অধিক জ্ঞানী। এ জবাবের কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে মূসা আলাইহিস সালাম-কে তিরস্কার করে ওহী নাযিল হল যে, দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে অবস্থানকারী আমার এক বান্দা আপনার চাইতে অধিক জ্ঞানী। একথা শুনে মূসা আলাইহিস সালাম প্রার্থনা জানালেন যে, তিনি অধিক জ্ঞানী হলে তার কাছ থেকে জ্ঞান লাভের জন্য আমার সফর করা উচিত। তাই বললেনঃ হে আল্লাহ! আমাকে তার ঠিকানা বলে দিন। আল্লাহ তা'আলা বললেনঃ থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে নিন এবং দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলের দিকে সফর করুন। যেখানে পৌঁছার পর মাছটি নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে, সেখানেই আমার এই বান্দার সাক্ষাত পাবেন। মূসা 'আলাইহিস সালাম নির্দেশমত থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তার সাথে তার খাদেম ইউশা’ ইবনে নূনও ছিল। পথিমধ্যে একটি প্রস্তর খণ্ডের উপর মাথা রেখে তারা ঘুমিয়ে পড়লেন। এখানে হঠাৎ মাছটি নড়াচড়া করতে লাগল এবং থলে থেকে বের হয়ে সমুদ্রে চলে গেল। (মাছটি জীবিত হয়ে সমুদ্রে যাওয়ার সাথে সাথে আরো একটি মু'জিযা প্রকাশ পেল যে,) মাছটি সমুদ্রের যে পথ দিয়ে চলে গেল, আল্লাহ তা’আলা সে পথে পানির স্রোত বন্ধ করে দিলেন। ফলে সেখানে পানির মধ্যে একটি সুড়ঙ্গের মত হয়ে গেল। ইউশা' ইবনে নূন্য এই আশ্চর্যজনক ঘটনা নিরীক্ষণ করছিল। মূসা আলাইহিস সালাম নিদ্রিত ছিলেন। যখন জাগ্রত হলেন, তখন ইউশা’ ইবনে নুন মাছের এই আশ্চর্যজনক ঘটনা তার কাছে বলতে ভুলে গেলেন এবং সেখান থেকে সামনে রওয়ানা হয়ে গেলেন। পূর্ণ একদিন একরাতে সফর করার পর সকাল বেলায় মূসা 'আলাইহিস সালাম খাদেমকে বললেনঃ আমাদের নাশতা আন। এই সফরে যথেষ্ট ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। নাশতা চাওয়ার পর ইউশা’ ইবনে নুনের মাছের ঘটনা মনে পড়ে গেল। সে ভুলে যাওয়ার ওযর পেশ করে বললঃ শয়তান আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। অতঃপর বললঃ মৃত মাছটি জীবিত হয়ে আশ্চর্যজনকভাবে সমুদ্রে চলে গেছে। তখন মূসা 'আলাইহিস সালাম বললেনঃ সে স্থানটিই তো আমাদের লক্ষ্য ছিল। (অর্থাৎ মাছের জীবিত হয়ে নিরুদ্দেশ হওয়ার স্থানটিই ছিল গন্তব্যস্থল। )
সে মতে তৎক্ষণাৎ তারা ফিরে চললেন এবং স্থানটি পাওয়ার জন্য পূর্বের পথ ধরেই চললেন। প্রস্তরখণ্ডের নিকট পৌঁছে দেখলেন, এক ব্যক্তি আপাদমস্তক চাদরে আবৃত হয়ে শুয়ে আছে। মূসা আলাইহিস সালাম তদাবস্থায় সালাম করলে খাদির ‘আলাইহিস সালাম বললেনঃ এই (জনমানবহীন) প্রান্তরে সালাম কোথা থেকে এল? মূসা ‘আলাইহিস সালাম বললেনঃ আমি মূসা। খাদির ‘আলাইহিস সালাম প্রশ্ন করলেনঃ বনী-ইসরাঈলের মূসা ? তিনি জবাব দিলেনঃ হ্যাঁ, আমিই বনী-ইসরাঈলের মূসা। আমি আপনার কাছ থেকে ঐ বিশেষ জ্ঞান অর্জন করতে এসেছি, যা আল্লাহ তা'আলা আপনাকে শিক্ষা দিয়েছেন। খাদির বললেনঃ যদি আপনি আমার সাথে থাকতে চান, তবে কোন বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না, যে পর্যন্ত না আমি নিজে তার স্বরূপ বলে দেই।
একথা বলার পর উভয়ে সমুদ্রের তীর ধরে চলতে লাগলেন। ঘটনাক্রমে একটি নৌকা এসে গেলে তারা নৌকায় আরোহণের ব্যাপারে কথাবার্তা বললেন। মাঝিরা খাদিরকে চিনে ফেলল এবং কোন রকম পারিশ্রমিক ছাড়াই তাদেরকে নৌকায় তুলে নিল। নৌকায় চড়েই খাদির কুড়ালের সাহায্যে নৌকার একটি তক্তা তুলে ফেললেন। এতে মূসা 'আলাইহিস সালাম (স্থির থাকতে না পেরে) বললেনঃ তারা কোন প্রকার পারিশ্রমিক ছাড়াই আমাদেরকে নৌকায় তুলে নিয়েছে। আপনি কি এরই প্রতিদানে তাদের নৌকা ভেঙ্গে দিলেন যাতে সবাই ডুবে যায়? এতে আপনি অতি মন্দ কাজ করলেন। খাদির বললেনঃ আমি পূর্বেই বলেছিলাম, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধরতে পারবেন না। তখন মূসা “আলাইহিস সালাম ওযর পেশ করে বললেনঃ আমি ওয়াদার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আমার প্রতি রুষ্ট হবেন না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ঘটনা বর্ণনা করে বললেনঃ মূসা 'আলাইহিস সালাম-এর প্রথম আপত্তি ভুলক্রমে, দ্বিতীয় আপত্তি শর্ত হিসেবে এবং তৃতীয় আপত্তি ইচ্ছাক্রমে হয়েছিল। (ইতিমধ্যে) একটি পাখি উড়ে এসে নৌকার এক প্রান্তে বসল এবং সমুদ্র থেকে এক চঞ্চু পানি তুলে নিল। খাদির ‘আলাইহিস সালাম মূসা আলাইহিস সালাম-কে বললেনঃ আমার জ্ঞান এবং আপনার জ্ঞান উভয়ের মিলে আল্লাহ্ তা'আলার জ্ঞানের মোকাবিলায় এমন তুলনাও হয় না, যেমনটি এ পাখির চঞ্চর পানির সাথে রয়েছে সমুদ্রের পানি।
অতঃপর তারা নৌকা থেকে নেমে সমুদ্রের তীর ধরে চলতে লাগলেন। হঠাৎ খাদির একটি বালককে অন্যান্য বালকের সাথে খেলা করতে দেখলেন। খাদির স্বহস্তে বালকটির মস্তক তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। বালকটি মারা গেল। মূসা আলাইহিস সালাম বললেনঃ আপনি একটি নিষ্পাপ প্রাণকে বিনা অপরাধে হত্যা করেছেন। এ যে বিরাট গোনাহর কাজ করলেন। খাদির বললেনঃ আমি তো পূর্বেই বলেছিলাম, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধরতে পারবেন না। মূসা “আলাইহিস সালাম দেখলেন, এ ব্যাপারটি পূর্বের চাইতেও গুরুতর। তাই বললেনঃ এরপর যদি কোন প্রশ্ন করি তবে আপনি আমাকে পৃথক করে দেবেন। আমার ওযর-আপত্তি চূড়ান্ত হয়ে গেছে।
অতঃপর আবার চলতে লাগলেন। এক গ্রামের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় তারা গ্রামবাসীদের কাছে খাবার চাইলেন। ওরা সোজা অস্বীকার করে দিল। খাদির এই গ্রামে একটি প্রাচীরকে পতনোন্মুখ দেখতে পেলেন। তিনি নিজ হাতে প্রাচীরটি সোজা করে দিলেন। মূসা আলাইহিস সালাম বিস্মিত হয়ে বললেনঃ আমরা তাদের কাছে খাবার চাইলে তারা দিতে অস্বীকার করলো। অথচ আপনি তাদের এত বড় কাজ করে দিলেন; ইচ্ছা করলে এর পারিশ্রমিক তাদের কাছ থেকে আদায় করতে পারতেন। খাদির বললেনঃ
هٰذَافِرَاقُ بَيْنِىْ وَبِيْنِكَ
অর্থাৎ এখন শর্ত পূর্ণ হয়ে গেছে। এটাই আমার ও আপনার মধ্যে বিচ্ছেদের সময়। এরপর খাদির উপরোক্ত ঘটনাত্ৰয়ের স্বরূপ মূসা আলাইহিস সালাম-এর কাছে বৰ্ণনা করে বললেনঃ
ذٰلِكَ تَاْوِيْلُ مَالَمْ تَسْطِعْ عَّلَيْهِ صَبْرًا
অর্থাৎ এ হচ্ছে সেসব ঘটনার স্বরূপ; যেগুলো আপনি দেখে ধৈর্য ধরতে পারেননি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করে বললেনঃ মুসা আলাইহিস সালাম যদি আরো কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরতেন, তবে আরো কিছু জানা যেত ৷ [বুখারীঃ ১২২, মুসলিমঃ ২৩৮০] এই দীর্ঘ হাদীসে পরিস্কার উল্লেখ রয়েছে যে, মূসা বলতে বনী-ইসরাঈলের নবী মূসা 'আলাইহিস সালাম ও তার যুবক সঙ্গীর নাম ইউশা" ইবন নূন এবং দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে যে বান্দার কাছে মূসা আলাইহিস সালাম-কে প্রেরণ করা হয়েছিল, তিনি ছিলেন খাদির ‘আলাইহিস সালাম। [ফাতহুল কাদীর]