আর তিনিই আসমানসমূহ ও যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেন, আর তাঁর ‘আর্শ ছিল পানির উপর [১], তোমাদের মধ্যে কে আমলে শ্রেষ্ঠ [২] তা পরীক্ষা করার জন্য [৩]। আর আপনি যদি বলেন, ‘নিশ্চয় মৃত্যুর পর তোমাদেরকে উত্থিত করা হবে’, তবে কাফেররা অবশ্যই বলবে, ‘এ তো সুস্পষ্ট জাদু [৪]।’
[১] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহর ডান হাত পরিপূর্ণ, দিন-রাত খরচ করলেও তা কমে না। তোমরা কি দেখ না যে, আসমান ও যমীনের সৃষ্টি সময় থেকে আজ পর্যন্ত তিনি কত বিপুল পরিমাণে খরচ করেছেন? তবুও তার ডান হাতের কিছুই কমেনি। আর তার আরশ পানির উপর অবস্থিত ছিল। তাঁর অন্য হাতে রয়েছে ইনসাফের দাঁড়িপাল্লা, সে অনুসারে বৃদ্ধি-ঘাটতি বা উন্নতি অবনতি ঘটান।[বুখারীঃ ৭৪১৯] অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, ইমরান ইবনে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ "শুধু আল্লাহ্ই ছিলেন, তাঁর পূর্বে কেউ ছিল না। আর তাঁর আরশ ছিল পানির উপর এবং তিনি যিকর বা ভাগ্যফলে সবকিছু লিখে নেন এবং আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেন। [বুখারীঃ ৩১৯১] অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,"আল্লাহ আসমান ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে সমস্ত সৃষ্টি জগতের তাকদীর লিখে রেখেছেন। আর তাঁর আরশ ছিল পানির উপর"। [মুসলিমঃ ২৬৫৩]
মোট কথা, কুরআনের ২১টি আয়াতে আরশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে সহীহ হাদীসেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরশের বিভিন্ন বর্ণনা দিয়েছেন। সে সমস্ত হাদীস মুতাওয়াতির পর্যায়ে পৌছেগেছে। মূলতঃ আরশ হলো আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি। সেটা প্রকাণ্ড ও সর্ববৃহৎ সৃষ্টি। আরশের সামনে কুরসী একটি রিং এর মতো, যেমনিভাবে আসমান ও যমীন কুরসীর সামনে রিং এর মতো। আরশের গঠন গম্বুজের মত। যা সমস্ত সৃষ্টি জগতের উপরে রয়েছে। এমনকি জান্নাতুল ফেরদাউসও আরশের নীচে অবস্থিত। আরশের কয়েকটি পা রয়েছে। মূসা আলাইহিসসালাম হাশরের মাঠে তার একটি ধরে থাকবেন। এ আরশের বহনকারী কিছু ফিরিশতা রয়েছেন। তাদের ব্যাপারে পবিত্র কুরআন ঘোষণা দিচ্ছেন যে, কিয়ামতের দিন তারা হবেন আট। [সূরা আল-হাক্কাহঃ ১৭] তবে এ ব্যাপারে ভিন্ন মত রয়েছে যে, আরশের বহনকারী ফিরিশতাগণ কি আট জন নাকি আট শ্রেণী নাকি আট কাতার। এ আয়াতে বর্ণিত পানির উপর আরশ থাকার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ্ তা'আলার আরশ কোন কিছু সৃষ্টি করার আগে পানির উপর ছিল। এর দ্বারা পানি আগে সৃষ্টি করা বুঝায় না। তবে এখানে পানি দ্বারা দুনিয়ার কোন সমুদ্রের পানি বুঝানো হয়নি। কেননা, তা আরো অনেক পরে সৃষ্ট। বরং এখানে আল্লাহর সৃষ্ট সুনিদিষ্ট কোন পানি উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। [এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, ইবনে কাসীর প্রণীত আল- বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ১ম খণ্ড]।
[২] লক্ষ্য করুন, আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ “কে কাজে শ্রেষ্ঠ” তা তিনি পরীক্ষা করবেন। তিনি ‘কে বেশী কাজ করেছে পরীক্ষা করবেন তা কিন্তু বলেননি। কেননা, আল্লাহ্র দরবারে পরিমানের চেয়ে মান-সম্মত হওয়াই গ্রহণযোগ্য। আর আল্লাহ্র দরবারে কোন কাজ মান-সম্মত সে সময়ই হতে পারে যখন তা আল্লাহর নির্দেশ মত এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত পস্থায় হবে। নতুবা তা গ্রহণযোগ্যতাই হারাবে।
[৩] এ বক্তব্যের অর্থ হচ্ছে, মহান আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবী এজন্য সৃষ্টি করেছেন যা মূলত তোমাদের (অর্থাৎ মানুষ) সৃষ্টি করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। অর্থাৎ এর মাধ্যমে সৃষ্টিকুলকে পরীক্ষা করা। তিনি সেটাকে অকারণে বা অনাহুত তৈরী করেন নি। তিনি নিজেকে এ ধরনের অনাহুত ও বেহুদা সৃষ্টি করা থেকে পবিত্র ঘোষণা করেছেন। তাছাড়া এটাও বলেছেন যে, কাফেররাই শুধু আসমান ও যমীনকে বেহুদা সৃষ্টি করেছেন বলে মনে করে থাকে। তাদের এ ধারণার জন্য তিনি তাদের উপর কঠোর সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, “আমি আকাশ, পৃথিবী এবং এ দুয়ের মধ্যবর্তী কোন কিছুই অনর্থক সৃষ্টি করিনি। অনর্থক সৃষ্টি করার ধারণা তাদের যারা কাফির, কাজেই কাফিরদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের দুর্ভোগ। [সূরা সোয়াদঃ ২৭] আরো বলেনঃ “তোমরা কি মনে করেছিলে যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার কাছে ফিরে আসবে না? মহিমান্বিত আল্লাহ্ যিনি প্রকৃত মালিক, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই; সম্মানিত আৱশের তিনি অধিপতি। [সূরা আল-মুমিনূনঃ ১১৫-১১৬] তিনি আরো বলেনঃ “আমি সৃষ্টি করেছি জিন এবং মানুষকে এজন্যেই যে, তারা একমাত্র আমারই ‘ইবাদাত করবে। [সূরা আয-যারিয়াতঃ ৫৬] হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ বলেন, তুমি ব্যয় কর, তোমার উপর ব্যয় করা হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, আল্লাহ্র হাত পরিপূর্ণ। কোন প্রকার ব্যয় তাতে কোন কিছুর ঘাটতি করে না। দিন-রাত তা প্রচুর পরিমানে দান করে। তোমরা আমাকে জানাও, আসমান ও যমীনের সৃষ্টিলগ্ন থেকে যত কিছু ব্যয় হয়েছে সেসব কিছু তার হাতে যা আছে তাতে সামান্যও ঘাটতি করে না। আর তার আরশ হচ্ছে পানির উপর এবং তার হাতেই রয়েছে মীযান, তিনি সেটাকে উপর-নীচু করেন।’ [বুখারী ৪৬৮৪; মুসলিম; ৩৭] অন্য হাদীসে ইমরান ইবন হুসাইন বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে প্রবেশ করলাম আর আমার উটটি দরজার কাছে বেঁধে রাখলাম। তখন তার কাছে বনু তামীম প্রবেশ করলে তিনি বললেন, বনু তামীম তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর। তারা বলল, সুসংবাদ তো দিলেন, এবার আমাদেরকে কিছু দিন (সম্পদ)। এটা তারা দু’বার বললেন। তখন রাসূলের কাছে ইয়ামেনের কিছু লোক প্রবেশ করল। তিনি বললেন, হে ইয়ামেনবাসী তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর, যখন বনু তামীম সেটা গ্রহণ করল না। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা তা গ্রহণ করলাম। তারা আরও বলল, আমরা এ বিষয়ে প্রথম কি তা জানতে চাই। তিনি বললেন, আল্লাহ্ই ছিলেন, তিনি ছাড়া আর কিছু ছিল না। আর তাঁর আরশ ছিল পানির উপর। আর তিনি সবকিছু যিকর (লাওহে মাহফুযে) লিখে রেখেছিলেন। আর তিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেন। বর্ণনাকার ইমরান ইবন হুসাইন বলেন, তখন একজন আহবানকারী ডেকে বলল, হে ইবনুল হুসাইন! তোমার উষ্ট্রীটি চলে গেছে। তখন আমি বেরিয়ে পড়ে দেখলাম, উটটি এতদুর চলে গেছে যে, যেদিকে তাকাই শুধু মরিচিকা দেখতে পাই। আল্লাহর শপথ আমার ইচ্ছা হচ্ছিল আমি যেন সেটাকে একেবারেই ছেড়ে দেই ( অর্থাৎ রাসূলের মাজলিস থেকে বের হতে তার ইচ্ছা হচ্ছিল না )" [বুখারী; ৩১৯১]
[৪] অর্থাৎ যখন আপনি তাদেরকে পুনরুত্থানের কথা বুঝাতে থাকেন তখন তারা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে এবং আপনাকে এ বলে বিদ্রুপ করতে থাকে যে, আপনি তো জাদুকরের মতো কথা বলছেন। এভাবে তারা আখেরাতের দাবী ও যৌক্তিকতাকে বুঝা সত্বেও মেনে নিতে পারেনি। অথচ যিনি একবার সৃষ্টি করেছেন তারপক্ষে পূনর্বার সৃষ্টি করা কোন ব্যাপারই নয়। আল্লাহ্ বলেনঃ “আর তিনিই সৃষ্টিজগতকে প্রথম সৃষ্টি করেছেন তারপর তিনিই তা পূনর্বার করবেন, এটা তার জন্য অত্যন্ত সহজ।" [সূরা আর রূমঃ ২৭] আল্লাহ আরো বলেনঃ “তোমাদের সৃষ্টি ও পূনঃসৃষ্টি তো একজনের মতই” [সূরা লুকমানঃ ২৮]